শিক্ষানবীশ শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে হাসপাতালে প্রথম নাইট ডিউটি করছিলেন সিলেটের চিকিৎসক মোহাম্মদ জোবায়ের চিস্তি। এক রাতেই তার চোখের সামনে নিউমোনিয়ায় মৃত্যু হলো তিন শিশুর।
শ্বাস নেয়ার সুবিধার জন্য তাদের কাউকে মাস্ক দিয়ে, কাউকে টিউব দিয়ে নাকের ভেতর ‘লো-ফ্লো’ পদ্ধতিতে অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছিল। এগুলো স্বল্প আয়ের দেশগুলোর জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া নির্দেশনা।
কিন্তু ডা. জোবায়ের চিস্তি দেখলেন, বাচ্চাগুলোর যে অবস্থা, তাতে এসব পদ্ধতি যথেষ্ট কার্যকর নয়। তাই তিনি আরও ভালো কোনো উপায় খুঁজতে লাগলেন। নিজেকে কথা দিলেন, এভাবে শিশুমৃত্যুর হার তিনি কমাবেন।
টানা প্রায় বিশ বছর গবেষণা শেষে অবশেষে ডা. চিস্তি বের করলেন নতুন এক উপায়, যা একই সঙ্গে শিশুদের খুবই কার্যকর এবং যথেষ্ট সস্তা। সেটি তৈরি শ্যাম্পুর বোতল দিয়ে!
গত বছর বিশ্বে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পাঁচ বছরের কম বয়সী ৯ লাখ ২০ হাজার শিশু মারা গিয়েছিল। তাই এই রোগটিকে শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে।
অবশ্য আগের চেয়ে এই সংখ্যাটা কমেছে। ২০১১ সালে সংখ্যাটি ছিল ১২ লাখ। কিন্তু কমার পরও বর্তমান পরিসংখ্যান বলছে, এটি বিশ্বজুড়ে মোট শিশুমৃত্যুর ১৬ শতাংশ। তাছাড়া এই অনুপাতটি সব দেশের জন্য সমান না। বাংলাদেশে ২৮ শতাংশ শিশুমৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া।
নিউমোনিয়া ফুসফুসকে আক্রমণ করে। স্ট্রেপটোকক্কাস জাতীয় ব্যাকটেরিয়া কিংবা শ্বাসযন্ত্রের সিনসিশিয়াল ভাইরাস (আরএসভি) সংক্রমণ ঘটায় ফুসফুসে। এর ফলে ফুসফুস ফুলে ভরে যায় পুঁজে বা তরল পদার্থে, যা অক্সিজেন গ্রহণ করে শ্বাস নেয়ার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
উন্নত দেশগুলোর হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে শ্বাস নেয়ার ব্যবস্থা করানো হয়। কিন্তু সেই একেকটি ভেন্টিলেটরের দাম ১৫ হাজার মার্কিন ডলার। শুধু তাই নয়, যন্ত্রগুলো চালানোর জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত কর্মীও প্রয়োজন।
কিন্তু স্বল্প আয়ের দেশে এতটা ব্যয়বহুল চিকিৎসা করানো সবার পক্ষে সম্ভব না। বিশেষ করে বাংলাদেশের নিম্ন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এভাবে নিউমোনিয়ার চিকিৎসা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে এসব ক্ষেত্রে নিউমোনিয়ায় শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে।
এছাড়া দরিদ্র পরিবারের শিশুদের মাঝে পুষ্টিহীনতা দেখা দেয় বেশি। পুষ্টিহীনতা শিশুর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়। ফলে নিউমোনিয়ার সংক্রমণের আশঙ্কা আরও বাড়ে। সংক্রমণের সময় যথেষ্ট পরিমাণ অক্সিজেন গ্রহণের শক্তিও পুষ্টিহীন শিশুর দেহে থাকে না।
এখানেই কাজে আসে ডা. চিস্তির তৈরি যন্ত্র। তার যন্ত্রটি এমনভাবে তৈরি, যেন তা শিশুর এই শ্বাস গ্রহণের কষ্টটাকে কমিয়ে দেয়।
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে কাজ করার সময় ডা. চিস্তি একটি বুদবুদ তৈরির বাবল-সিপিএপি (কন্টিনিউয়াস পজিটিভ এয়ারওয়ে প্রেশার) যন্ত্র দেখেছিলেন। সেখান থেকেই নতুন মেশিনটি তৈরির বুদ্ধি আসে তার মাথায়।
অস্ট্রেলিয়ায় দেখা যন্ত্রটি ফুসফুসে নিয়মিত বাতাসের যোগান দিয়ে ইতিবাচক চাপ তৈরি করে, যেন ফুসফুস কাজ করা থামিয়ে না দেয়। শরীরেও পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন পৌঁছায়। প্রচলিত ভেন্টিলেটরের চেয়ে দাম কম হলেও (৬ হাজার ডলার) সেই যন্ত্রটিও বেশ দামি।
কর্মসূত্রে দেশে ফিরে আইসিডিডিআর’বিতে যোগ দিয়ে তিনি কাজ শুরু করেন সহজ ও সস্তা একটি বাবল সিপিএপি যন্ত্র তৈরির জন্য।নিউমোনিয়া-শিশু-শ্যাম্পুর বোতল
২০১৫ সালে সহকর্মীদের সঙ্গে ডা. চিস্তি কাজ করছিলেন হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট থেকে ফেলে দেয়া একটি প্লাস্টিকের শ্যাম্পু বোতল নিয়ে। প্রথমে তাতে পানি ভরে অন্য প্রান্তের খানিকটা প্লাস্টিকের অংশ ডুবিয়ে দিয়েছিলেন অন্য একটি টিউবে।
জোবায়ের চিস্তি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘বাচ্চারা টিউবের মাধ্যমে একটি জলাধার থেকে অক্সিজেন টেনে নেয়। এরপর টিউবের সাহায্যেই নিঃশ্বাস ছাড়ে। ওই টিউবটি ডোবানো থাকে একটি পানির বোতলের মধ্যে, যার ফলে বাতাসে বুদবুদ সৃষ্টি হয়।’
বুদবুদ থেকে সৃষ্ট চাপ ফুসফুসের মধ্যে ছোট বায়ুথলিগুলোকে খুলে রাখতে সাহায্য করে।
‘চার-পাঁচটি রুগ্ন শিশুর ওপর পরীক্ষা চালিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আশাতীত উন্নতি দেখতে পাই, বলেন তিনি’
দু’বছর পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে ডা. চিস্তি ফল প্রকাশ করেন দ্য ল্যান্সেট জার্নালে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের যন্ত্রের মাধ্যমে অল্পমাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহের চেয়েও এই বাবল সিপিএপি যন্ত্রের মাধ্যমে চিকিৎসা করিয়ে মৃত্যুহার অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।
এতে খরচও পড়বে মাত্র ১.২৫ ডলারের মতো। বাস্তবেই যন্ত্রটি ব্যবহারে শিশুমৃত্যুর হার ৭৫ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল।
বিশ বছর আগে নিজেকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে পেরে আবেগাপ্লুত হয়ে জোবায়ের বলেছিলেন, অনুভূতি প্রকাশের কোনো ভাষা নেই তার।
তিনি চান উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিটি হাসপাতালে যেন তার শ্যাম্পুর বোতল দিয়ে তৈরি শুরু হওয়া এই সিপিএপি যন্ত্রটি ব্যবহার হয়। হাসপাতালগুলো যেন এ যন্ত্র সুলভে পেতে পারে তার ব্যবস্থাও করতে চান তিনি।
‘যখন সেই দিনটি আসবে, আমরা বোধহয় বলতে পারব, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুমৃত্যুর হার প্রায় শূন্যে পৌঁছেছে,’ বলেন এই চিকিৎসক।